ব্যালান্স শিট ( Balance Sheet )
(By Debarati Mukhopadhyay) Read EbookSize | 20 MB (20,079 KB) |
---|---|
Format | |
Downloaded | 570 times |
Last checked | 7 Hour ago! |
Author | Debarati Mukhopadhyay |
আশৈশব বাপসোহাগি দিব্যদর্শিনীর কোনদিনই মায়ের সঙ্গে তেমন বনেনি। বাবা-ই ছিলেন তার প্রিয়তম বন্ধু, দুঃখে আনন্দে প্রিয়তম সখা। হিমালয়ের মত প্রকাণ্ড কিন্তু স্নিগ্ধ, তপস্যারত কোন প্রাচীন ঋষির মত অবিচল, আদর্শনিষ্ঠ ছিল তার বাবার ব্যক্তিত্ব। আধ্যাত্মিকতাকে হাসি ও হিউমারের মোড়কে পেশ করে নিজের আদরের কন্যাকে তিনি হাতে ধরে এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মুক্তির পথে। কিন্তু বাবার সহসা মৃত্যু দিব্যদর্শিনীকে টুকরো টুকরো করে দিয়ে যায়, আকুল কিশোরীর মত সে তখন আঁকড়ে ধরে নিজের সমবয়সী স্বামী অনুরণকে। একদা কলেজের সহপাঠী স্বামীকে সে পেতে চায় প্রিয়তম বন্ধুরূপে। দিব্যদর্শিনীর জীবনের ঘাত প্রতিঘাত শেষ হয় না।
তার ব্যস্ত জীবনটা কাঁচের শিশির মত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় যখন তার তার প্রথম সন্তান জন্মানোর কয়েকঘন্টার মধ্যে ডাক্তার জানান, শিশুটি জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মেছে, আয়ু বড়জোর এক সপ্তাহ। অহেতুক কাটাছেঁড়া না করে শান্তিতে তাকে চলে যেতে দেওয়াই ভাল। স্বামী অনুরণকে পাশে নিয়ে দিব্যদর্শিনী বুকের পাথর চেপে সন্তানকে দুধ খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, আর প্রতীক্ষা করে সন্তানের মৃত্যুর। যে স্বামী তার সেবা করে আপ্রাণ, সন্তানের মৃত্যুর পরপর সমান্তরালে চলা স্বামীর অন্য সম্পর্কের কথা জানতে পেরে আরো দিশেহারা হয়ে পড়ে দিব্যদর্শিনী। দুঃসহ সন্তানশোক, স্বামীর প্রতারণার আঘাত সামলাতে না সামলাতে অফিসে বদলি হয় তার। নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত দিব্যদর্শিনীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় উত্তরবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রাম বদনপুরের ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার করে।
অদ্ভুত সেই বদনপুর গ্রাম। উত্তরবঙ্গের আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের মত সেখানে চা বাগানও নেই, নেই কোন চাষবাস বা শিল্প। কিন্তু ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের কাছের গ্রাম বদনপুর তবু বাকি সমস্ত গ্রামের চেয়ে স্বতন্ত্র। কারণ, সেই গ্রামে রয়েছে গোটা অঞ্চলের একমাত্র শ্মশান, যেখানে কোন না কোনদিন পুড়তে আসে আশপাশের সমস্ত গ্রামের মানুষ। গ্রামের কোথাও থাকার জন্য ঘরভাড়া না পেয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান পরেশবাবুর হস্তক্ষেপে দিব্যদর্শিনীর থাকার জায়গা হয় শ্মশানলাগোয়া এক বাড়িতে।
নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত দিব্যদর্শিনী প্রবল শোকের মধ্যেও মুখোমুখি হয় এক অচেনা ভারতবর্ষের। যেখানে দু-বেলা ভরপেট খেতে পাওয়াটাই বিলাসিতা, সেখানে দাঁড়িয়ে রুরাল ব্যাংকিং এর প্রতিটি স্তরে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। নিজের পুঁথিগত বিদ্যা, হাতেকলমে ব্যাংকিং এর অভিজ্ঞতা সেখানে হার মানে, রাশ টেনে ধরে অচেনা আবেগ। মুখোমুখি হতে হয় অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার। বাঙালি, মদেশীয়, কোচ, গারো, এমন নানাবিধ জাতি উপজাতির সান্নিধ্যে কর্মসূত্রে আসতে হয় তাকে। আদিবাসী রমণী ঘুনসি তাকে দেয় নতুন জীবনের পাঠ। তাদের সঙ্গে তাদের মত করে দিব্যদর্শিনী অনুভব করতে শেখে জীবনকে। শিবরাম পাঁড়ে, বুধন বরাইক, জিতেন কুড়ির মত বিস্ময়কর সমস্ত চরিত্রের দেখা মেলে তার জীবনপথে। পূর্ববঙ্গে সর্বস্ব ফেলে আসা রুক্ষস্বভাবা কর্কশ প্রৌঢ়া ভক্তিমায়াই হোক বা শ্মশানের শখের ডোম দূরবীন, দিব্যদর্শিনীকে তারা ভাবতে শেখায় নতুন করে। দিব্যদর্শিনী বিস্মিত হয় ক্রমশ। তার মহাপন্ডিত বাবা উপনিষদের যে শ্লোক আবৃত্তি করতেন, শংকরাচার্যের যে ভাষ্য উদ্ধৃত করে বোঝাতেন শাশ্বত জীবনবোধ, ভক্তিমায়া হোক বা দূরবীন, তাদের কথাতেও যেন সেই ছাপ। প্রত্যেকেই যেন নিজেদের মত করে মুক্তির পথ খুঁজছে। কেউ বেছে নিয়েছে ভক্তিযোগকে, কেউ আবার কর্মযোগকে। তাদের জীবনে সহজ সরলে আসে উপনিষদ। বেদ। বেদান্ত।
শ্মশানের মড়াপোড়া গন্ধের মাঝে দিন শুরু হয় দিব্যদর্শিনীর। শ্মশানের সঙ্গে বসবাস করতে করতে তার ইগো, তার অভিমানবোধ, তার অহং মিশে যায় ধুলোয়। তার দিন শেষ হয় গ্রামবাংলার দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর মাঝে। অচেনা এই জীবনে প্রেম অপ্রেম হিংসা মিথ্যা প্রতারণা প্রবঞ্চনা ক্রমশ ঠুনকো লাগতে থাকে দিব্যদর্শিনীর চোখে। ক্রমশ সে উপলব্ধি করে, সবই গুরুত্বহীন, চিরন্তন সত্য লুক্কায়িত রয়েছে একমাত্র মানুষ হিসেবে উত্তরণে। উপনিষদের ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’তে। নিজের দুঃখ, কষ্ট, বেদনায় ভরা ক্ষুদ্র ‘কাঁচা আমি’কে ভেঙে ফেলে ক্রমশ সে ছুটে যেতে চায় ‘পাকা আমি’র দিকে। যে ‘আমি’ মনুষ্যত্বের কথা বলে। যে ‘আমি’ জাগ্রত করে তোলে বিবেককে, বৈরাগ্যকে। যে ‘আমি’ ক্রমশ মিলন ঘটায় আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার, জাগিয়ে তোলে চৈতন্যকে। আধুনিক এক ব্যাংকারের সঙ্গে শখের এক ডোমের তৈরি হয় এক অদ্ভুত উদাসীন সম্পর্ক, যা ফেলা যায় না কোন চেনা সমীকরণে।
স্থূলদৃষ্টিতে ভারতবর্ষের গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থা অব্যবস্থার কথা তুলে ধরে এই উপন্যাস। হিসেব করে রুরাল ব্যাংকিং এর ব্যালান্স শিটের। সূক্ষ্মদৃষ্টিতে সমান্তরালে লেখা হয় অন্য এক ব্যালান্স শিট, যা নিঃস্পৃহভাবে হিসেব করে মানুষের চাওয়া পাওয়া, পাপ পুণ্যের। কোনটা ডেবিট, কোনটা ক্রেডিট, কোনটা অ্যাসেট, কোনটা আসলে লায়াবিলিটি, তা বুঝতে ধাঁধা লেগে যায় এই অগণিত চরিত্রের আশ্চর্য ‘ডিস্টোপিয়ান’ উপন্যাসে। জাগ্রত, সুষুপ্তি দশা পেরিয়ে প্রশান্ত মন ছুটে চলে তুরীয় অবস্থার দিকে। নেতিবাচকতার অন্ধকার পেরিয়ে দেখা দেয় আশার আলো।”